Description:
ভ্রমণ ব্যাপারটা অনেকটা নেশার মতো।যত বেশি ঘোরাঘোরি করা হয়, ভ্রমণপিপাসু মন যেন তত উৎসুক হয়ে ওঠে অদেখাকে দেখার জন্য।তাইতো অজানার হাতছানিতে বারবার ছুটে যাওয়া হয় নতুনের খোঁজে।এভাবে ছুটতে ছুটতেই আমার দেখা হয়েছে সমুদ্র,নাম না জানা অংখ্য নদী-হাওড়-লেক,পাহাড় পর্বত,দুর্গম ঝড়না,বন জংগল আর পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন।আর এসব দেখতে দেখতে উপলব্ধি হয়েছে আমাদের দেশের সৌন্দর্য আসলে কতটা বিস্তৃত।কতটা গভীর এদেশের শেকড়।
দেশের দক্ষিনাঞ্চলে অবস্থিত বান্দরবান ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বলতে গেলে একরকম স্বর্গ।এখানে পরিবার নিয়ে যেমন নিরিবিলিভাবে অবকাশযাপন করা যায় চিরচেনা কোন স্থানে,তেমনি বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেড়িয়ে পড়া যায় এডভ্যাঞ্চারের জন্য অজানা কোন জায়গার উদ্দেশ্যে।তাইতো বান্দরবান সম্পর্কে বরাবরই মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।
যাওয়ার উপায়ঃ ঢাকার গাবতলী,কলাবাগান,হাতিরপুল,আরামবাগ বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিনই বান্দরবানের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়।এক দুইদিন আগে থেকেই এসব বাসের টিকেট পাওয়া যায়।টিকেটের মূল্য নির্ভর করে কোন বাসে যাওয়া হচ্ছে তার উপড়।তবে কমপক্ষে ৯০০ টাকা মতো লাগে যাবার জন্য।
দর্শনীয় স্থানঃ বগালেক এবং কেওক্রাডং
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে বান্দরবানের বগালেক এবং কিওক্রাডং এ যাবার জন্য নিজস্ব গাইডের প্রয়োজন।আর এই গাইডের ইনফরমেশন পাওয়া যাবে গুগল সার্চ করেই।গাইডের নাম্বার জোগাড় করে তার সাথে যোগাযোগের করে ট্যুর প্ল্যান করা উচিত।
বগালেকঃ বান্দরবানে অবস্থিত বগালেক নামক এই লেকটি খুব শান্তশিষ্ট।এই লেকটির পানির স্রোত টাও বুঝি অন্য কারও অনুমতি ব্যতীত একপাশ থেকে আরেকপাশে যাবেনা।খুব সুন্দর একটা নীল রঙ্গে পানিটা ছেয়ে থাকে,যদিও এটা অনেকটা নির্ভর করে আকাশের অবস্থার উপর।বগালেকের সৌন্দর্য দেখে যে শব্দটা বারবারই আমার মাথায় এসেছিল সেটা হল “অমায়িক”।সমুদ্রের মতো না আছে এর বিশালতার দাম্ভিকতা, টাঙ্গুয়ার হাওড়ের মতো না আছে পর্যটককে সৌন্দর্যে মাতাল করবার প্রচেষ্টা।বরং ছোট ছোট ঢেউ আর বাতাসের দোলা দিয়ে মনটাকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলার আবেদন ই যেন তার উদ্দেশ্য।
যেকোন পানির জায়গার মতোই আঁধার হওয়ার সাথে সাথে বগালেকও অন্যরকম এক রূপ ধারন করে।দিনের বেলায় যে জায়গাটি ভীষণ চেনা কোন বন্ধু মনে হয়,দিনের আলো চলে যেতেই তা অদ্ভুত রকমের অচেনা লাগতে থাকে।খুব বেশি ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় আঁধারে ছেয়ে থাকা বগালেকের পাশে বসে গড়ে ওঠে আড্ডা আর গানের মেলা।পুরো পরিবেশটা আশ্চর্যরকমের এক ভালোলাগার সৃষ্টি করে।পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে নিরিবিলি সময় কাটাবার জন্য উপযুক্ত স্থান এই বগালেক।
বগালেকে যাবার জন্য বান্দরবানে পৌছাবার পর বাস থেকে নেমে সেখানে রুমা বাজার নামে একটি জায়গা থেকে দ্বিতীয় বাসে উঠতে হয়।দ্বিতীয় বাস নির্দিষ্ট স্থানে পৌছাবার পর গাইডের সাহায্যে কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ করার পর বগালেক পর্যন্ত যাবার জন্য জীপ বা চাঁদের গাড়ি ভাড়া করতে হয়।চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টার মাঝে বগালেক চলে যাওয়া যায়।
কেওক্রাডংঃ বান্দরবানের অন্যতম সুন্দর একটি জায়গা হল এই কেওক্রাডং।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই পাহাড়টিকে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু স্থান।বান্দরবানের রুমা নামক স্থানে অবস্থিত কেওক্রাডং পাহাড়টি বাংলাদেশ আর্মির আওতাধীন।তাই এখানে থাকার জন্য কটেজ ভাড়া থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়া সবকিছুর ব্যবস্থা আর্মির পারমিশন নিয়ে আগে থেকেই করে রাখতে হয়,যেটা সাথে থাকা গাইডই করে দেবে।
বগালেক থেকে কেওক্রাডং যাবার দুটো উপায় আছে।একটি ট্র্যাকিং আরেকটি জীপে করে যাওয়া।জীপে করে যেতে চাইলে সাথে থাকা গাইডকে জীপ ভাড়া করার কথা আগে থেকে বলে রাখতে হয়।তবে বগালেক থেকে কেওক্রাডং এর মাঝখানের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ট্র্যাকিং এর বিকল্প নেই।চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার এই ট্র্যাকিং এর রাস্তাটা বন আর পাহাড়ের মাঝখানে চলে গেছে।গাইডের ডিরেকশনে কিছুদূর পর পর বিশ্রাম নিয়ে হাটতে থাকলে পাঁচ ঘণ্টার মাঝেই কেওক্রাডং পৌছানো যায়। সূর্য মাথার উপর পৌছানোর আগেই জানি অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া যায় তাই সকাল সকাল ই ট্র্যাকিং এর জন্য রওনা হয়ে যাওয়া ভাল।বুনো ঘাস মাড়িয়ে, নাম না জানা গাছপালার মাঝখান দিয়ে, অচেনা কোন পাহাড় বা মাটির টিলা পাশ কাটিয়ে, পাখির কলকাকলি শুনতে শুনতে আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে ট্র্যাকিং এর এই সময়টাই হয়ে উঠবে পুরো বান্দরবান ট্যুরের অন্যতম স্মরনীয় একটি স্মৃতি।
ট্র্যাকিং করার পথে পড়বে ছোটখাট অনেক ঝর্ণা।লোকালয় থেকে দূরে বিস্তীর্ণভাবে গড়ে ওঠা এসব বুনো ঝর্ণাগুলোর নৈসর্গিক সৌন্দর্য এতটাই মোহনীয় যে এর পিছুটান অনেকটা সময় পর্যন্ত থেকে যায়।পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়তে থাকা পানির শব্দ শুনতে শুনতে ঝর্ণার পাশে বসে সহজেই কয়েক ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।এমনকি অতি বিভোর হয়ে ট্র্যাকিং এর কথা বেমালুম ভুলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না।
ট্র্যাকিং এর শেষভাগটায় উপজাতীয় কিছু এলাকার মাঝখান দিয়ে যেতে হয়।এখানে টুকটাক কিছু দোকান থাকে যেখান থেকে খাবার দাবার কিনে নেওয়া যেতে পারে।ট্র্যাকিং শেষে কেওক্রাডং এ পৌছালে বগালেকের অনুরূপ কাগজপত্রে সাক্ষরের মতো কিছু আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম শেষ করে গাইডের সাহায্যে পাহাড়ের চুড়ায় বা নীচে কটেজ রুম পাওয়া যায়।পাহাড়ের চুড়ায় কটেজ রুমগুলোর জানালা এবং ব্যালকনি দিয়ে দূরের নীল পাহাড় আর নীল আকাশের যে দৃশ্য দেখা যায় তা সহজেই ইন্দ্রিয়কাবু করে।
কেওক্রাডং এ একটি হ্যালিপ্যাড আছে যেখান থেকে পুরো সূর্যাস্ত দেখা যায়।সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত সেখানে থাকার অনুমতি আছে।তবে সূর্যাস্ত দেখার জন্য কেওক্রাডং ঘুরতে আসা সব পর্যটকের ভীড়ে হ্যালিপ্যাড লোকারন্য হবার আগেই বিকেলের দিকে ওখানে চলে যাওয়া ভাল।
দিনের সূর্য ডুবে যাওয়ার পর যখন কেওক্রাডং এর বুকে আঁধার নেমে আসে তখন যে অদ্ভুত এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় তা আসলে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।সেই সাথে মাথার উপর যদি থাকে বিশাল চাঁদ তাহলে আসলে কেওক্রাডং এর কাছে আপনার আর কিছু চাওয়ার থাকবেনা।পাহাড়ের চূড়া ঘেষে রয়েছে বসার ব্যবস্থা যেখানে সন্ধ্যার পর পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আড্ডা আর গানে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পরিবেশ।এসময়গুলোতে দূরে তাকালে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় পাহাড়,কোন কোন পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে হয়তো বয়ে গেছে নাম না জানা ছোট খাট কোন নদী।আর এগুলোর উপর যখন চাঁদের রুপোলি আলো এসে পড়ে তখন মনে হয় বহুকালের কত রহস্য না জানি ওই জায়গাগুলোতেই লুকোনো আছে।
টুকিটাকি মনে রাখাঃ
-বান্দরবান পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় অনেক হাটতে হয়।তাই সে অনুযায়ী জুতা সাথে নিতে ভুলবেন না।
-কেওক্রাডং এর উপরে পানির সংকট থাকায় গোসলের জন্য পানি কেনা লাগে।প্রতি বালতি পানি ৫০ টাকা করে পড়ে।খেয়াল রাখবেন পানির অপচয় যাতে না হয়।
-বান্দরবানের বগালেক এবং কেওক্রাডং দুটো জায়গাতেই থাকার জন্য কটেজে ভাড়া জনপ্রতি হিসেবে হয়।৩০০ টাকা জনপ্রতি থাকার খরচ একেকদিনের।আর একেকবেলার খাবার খরচ জনপ্রতি ২০০টাকা করে পড়ে।ট্র্যাকিং করে কেওক্রাডং গেলে সবমিলিয়ে জনপ্রতি ৫৫০০ টাকার মাঝে বগালেক আর কেওক্রাডং ঘুরে আসা যায়।তবে জীপে করে কেওক্রাডং গেলে খরচ কিছুটা বাড়তে পারে।
-সবশেষে ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন।কারণ দেশটা আমাদেরই,তাই দেশটা পরিষ্কার রাখা আমাদেরই দায়িত্ব।