সোনারগাঁও স্বর্ণগ্রাম বা সুবর্ণগ্রাম নামে অভিহিত বঙ্গের এক প্রাচীন জনপদ। এই জনপদে ‘স্বর্ণভূষিত’ জাতি নামে চিহ্নিত এক আদিম জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল যারা ঐতিহ্যগতভাবেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করতো। সোনারগাঁ সংলগ্ন পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে অবস্থিত হিন্দুদের দুটি ঐতিহ্যবাহী পবিত্র স্নানতীর্থ লাঙ্গলবন্দ ও পঞ্চমীঘাট এ অঞ্চলের প্রাচীন গুরুত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বহু পূর্বে সোনারগাঁও এলাকায় একটি স্বাধীন রাজ্যের রাজধানী ছিল এমন লোকশ্রুতি নির্ভর বিবরণ রয়েছে। সম্ভবত তেরো শতকের সত্তুরের দশকে রাজা দনুজ রায়ের অধীনে সোনারগাঁও স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ কর্তৃক ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম স্বাধীন মুসলিম সালতানাতের রাজধানী ছিল সোনারগাঁও, আর তখন থেকেই শুরু হয় সোনারগাঁয়ের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দর শাহের শাসনামলে সোনারগাঁও ছিল পূর্ববঙ্গ প্রদেশের রাজধানী। পূর্ববঙ্গে গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের স্বাধীন শাসনামলে তাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। ঈসা খান মসনদ-ই-আলা প্রতিষ্ঠিত ভাটি রাজ্যের রাজধানী ছিল সোনারগাঁয়ে। মুগলের নিকট ইসা খার পুত্র মুসা খানের পরাজয়ের পর সোনারগাঁয়ের রাজনৈতিক প্রাধান্য লোপ পায়। সমুদ্রপথে পশ্চিম এশীয় ও দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশ থেকে বাণিজ্য-তরী সহজেই সোনারগাঁয়ে পৌঁছতে পারত। ইবনে বতুতা (১৩৪৬) সোনারগাঁওকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-নগরী রূপে বর্ণনা করেন এবং চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন।সোনারগাঁয়ে প্রস্ত্তত মসলিন, বিশেষত ‘খাস’ নামীয় অত্যুৎকৃষ্ট মসলিন সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করে। ঢাকা নগরীর প্রতিষ্ঠার পর থেকে সোনারগাঁও তার প্রাধান্য হারাতে থাকে এবং ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে সোনারগাঁও পরিণত হয় ‘গভীর জঙ্গলে আচ্ছাদিত গন্ড গ্রামে’। কিন্তু প্রায় এক শতক কালের ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যোগাযোগ সুবিধার ফলে শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মধ্যবর্তী ভূভাগ এখন পরিণত হয়েছে একটি উৎপাদনশীল এলাকায়। মোগরাপাড়ায় সম্প্রতি গড়ে ওঠা আধুনিক বসতি দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং এতে করে দিনে দিনে এলাকাটি রূপ নিচ্ছে একটি উপশহরের।