আমার জন্ম সীতাকুন্ড সংলগ্ন এলাকায় পাহাড়ের কোলে এবং জন্মাবধি আমি এসকল পাহাড়সমূহ দেখে, এদের কোলে খেলে বড় হয়েছি। একটু বড় হবার পর ২০০৪ সাল থেকে আমি সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় ও তদসংলগ্ন এলাকায় ঘুরাঘুরি শুরু করি। কোন এক অমোঘ আকর্ষণে আমি এই এলাকায় ছুটে গিয়েছি বার বার। এখন পর্যন্ত চন্দ্রনাথের চূড়োয় মেলার সময় বাদে ১২ বার আরোহণ করেছি, সলো করেছি, অনেক ঝামেলা করে চন্দ্রনাথ চূড়োয় রাত কাটিয়েছি। শুধু হিন্দু ধর্মে নয় বরং বৌদ্ধ ধর্মানুসারেও এ পাহাড় পবিত্র এবং এ পাহাড়ের চূড়ায় যে শিবমন্দিরের পাশাপাশি একটি বৌদ্ধ জাদি আছে তা আমাদের অনেকেরই অজানা। জাতক কাহিনীর মিথ বলে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থ এ পাহাড়ে আরোহণ করেছিলেন। হাজার হাজার মানুষের মত আমার প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণও দুই দুইবার আরোহণ করেছেন এই পাহাড়ে। সব পাহাড়ই স্পেশাল ও পবিত্র। কারণ বিশাল পাহাড়ের সামনে দাড়ালেই নিজের ক্ষুদ্রতা ও স্রষ্টার/প্রকৃতির বিশালতা অনুধাবন করা যায় নিজের মত করে। তবু কেন জানি চন্দ্রনাথ শীর্ষ আমার কাছে একটু বেশিই স্পেশাল। একটু বেশিই পবিত্র। তাই মোহগ্রস্থ হয়ে বার বার এখানে ফিরে আসা আমার কাছে এক অন্তর্যাত্রা। আমি আমার এই অনুভূতি ছড়িয়ে দিতে চাই অন্যদের মাঝেও যারা সময়-সুযোগ ও উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে চাইলেও চট্টগ্রামের সবচে উচু এই পাহাড়টিকে (১১৫৮ ফুট) আলিংগণ করতে পারছেন না। (পাহাড় জয় এই শব্দটির ঘোর বিরোধী আমি, পাহাড়কে কখনো জয় বা পদানত করা যায় না, পাহাড় মানুষকে বিনয়ী ও নিরহংকারী করে, জয় টাইপের কোন বিশেষণ তাই এখানে নিস্প্রয়োজন)
চন্দ্রনাথ মন্দির ও শীর্ষ স্পেশাল এই কারণে যে এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাচটি শিবমন্দিরের একটি। বাকিগুলো হলো নেপালের পশুপতিনাথ, কাশিতে বিশ্বনাথ, পাকিস্তানে ভুতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ। পুরাণানুসারে অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাসের সময় তার ভাই লক্ষণ ও স্ত্রী সীতাসহ এখানে এসেছিলেন। মহামুণি ভার্গব তাঁরা আসবেন জানতে পেরে তাঁদের স্নানের জন্য তিনটি কুণ্ড সৃষ্টি করেন এবং রামচন্দ্রের এখানে ভ্রমণ কালে তাঁর স্ত্রী সীতা এই কুণ্ডে স্নান করেন। এই কারনেই এখানকার নাম সীতাকুণ্ড বলে অনেকে ধারনা করেন। সতীত্বের পরীক্ষা সংক্রান্ত আরেকটি মিথও শোনা যায়। তাছাড়া আরেক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞের পর সতী মাতা দেহ ত্যাগ করলে হিমালয় পর্বতে মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করলে বিষ্ণু দেব সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহখন্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় এবং এ সকল স্থানসমূহ শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়। এখানে হিন্দু সতী দেবীর দক্ষিণ হস্ত পতিত হয়েছিল।
পৌরাণিক কাহিনী ছাড়াও নব্যপ্রস্তর যুগের দিকে সীতাকুণ্ডে মানুষের বসবাস শুরু হয় বলে ধারনা করা হয়। চন্দ্রনাথ সংলগ্ন এলাকা থেকে আবিষ্কৃত প্রস্তর যুগের জনগোষ্ঠীর হাতিয়ার গুলো তারই প্রমাণ বহন করে। ১৮৮৬ সালের দিকে এখান থেকে দশ হাজার বছর আগের হাতিয়ার পাওয়া যায় বলে ভারতীয় প্রত্নতত্ববিদ রাখালদাশ বন্দোপাধ্যায় তার বই "বাংলার ইতিহাস" এ উল্লেখ করেন।